মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন গত সপ্তাহেই পাকিস্তান বলেছে যে তারা তাদের ভুখন্ড থেকে জঙ্গী গ্রুপগুলো যেন কাজ করতে না পারে এজন্য আরো বেশি কিছু করতে পারে। কিন্তু বিবিসির ওই তদন্তে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে প্রকাশ্যে পাকিস্তান ওয়াশিংটনের মিত্র হলেও গোপনে তারা তালেবানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
বিবিসির সংবাদদাতা ডেভিড লোয়েন বলছেন, ২০০৬ সালে যখন আফগানিস্তানে ব্রিটিশ ও আমেরিকান সেনাদের হতাহত হবার সংখ্যা হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গিয়েছিল – ওই সময়ই পাকিস্তান তালেবানকে সহায়তা করা বাড়িয়ে দেয় বলে মনে করা হচ্ছে। একজন তালেবান কমান্ডার এবং একজন আত্মঘাতী হামলাকারী উভয়েই বিবিসিকে বলেছেন যে তারা পাকিস্তানী সৈন্য এবং আইএসআইএর লোকদের কাছ থেকেই বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করা একজন তালেবান কমান্ডার বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর লোকেরা গাড়িতে করে সকাল আটটার সময় আসতো এবং বিকেল চারটার সময় চলে যেতো। তাদের পরনে থাকতো সামরিক উর্দি , আইএসআই-এর পোশাক। ওই সামরিক কমান্ডাররা আমাদেরকে বিশেষায়িত অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতো।‘
আরেকজন তালেবান বিদ্রোহী বলছেন, ‘আমাদেরকে একটা কালো জানালাওয়ালা কালো গাড়িতে তোলা হলো, যা স্পষ্টতই আইএসআইএর গাড়ি। পুলিশ বা অন্য কেউ এসব গাড়ি থামানোর সাহস পায় না । আমরা লান্ডিকোটাল দিয়ে একটা পাহাড়ি এলাকায় গেলাম, জালালাবাদের কাছে সকাল আটটায় আমাদের জন্য লোক অপেক্ষা করছিল। তারা আমাকে বললো, দুপুরে খাবার সময় তুমি বিস্ফোরক ভর্তি পোশাক পেয়ে যাবে। আফগান পুলিশ বা সেনাবাহিনীর লোক খুঁজে বের করো। তবে আমি এ কাজ করতে চাই নি।‘
সীমান্তের কাছাকাছি থাকা মার্কিন সৈন্যরাও বলেছেন, তারা দেখতে পেয়েছেন পাকিস্তানী সৈন্যরা তালেবানকে সাহায্য করছে।
একজন সাবেক সিআইএ-র এজেন্ট ব্রুস রিডেলকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা দায়িত্ব দিয়েছিলেন পাকিস্তানের এই গোপন যুদ্ধের ব্যাপকতা সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য। তিনি বলছেন, তার পাওয়া গোয়েন্দা তথ্য থেকে এ ব্যাপারে সংশয়ের কোন অবকাশ থাকে না । তিনি বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা তথ্য ছিল দ্ব্যর্থহীন। আফগানিস্তানের বিদ্রোহীরা শুধু যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার পরোক্ষ সমর্থন পেতো, তাই নয় – এ সমর্থন ছিল সক্রিয়। পাকিস্তান অর্থ সংগ্রহ করছিল, তালেবানকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল, এমনকি নেটো বাহিনীর ওপর আক্রমণের জন্য তালেবানের সাথে বিশেষজ্ঞদের পাঠাচ্ছিল।‘
যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত ছিল যে ২০০৮-এর মুম্বাই হামলার পেছনেও পাকিস্তানের নির্দেশ ছিল। মি. রিডেল বলছেন, পাকিস্তানের ভেতরে বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে মার্কিন ড্রোন হামলাগুলো তখনই সফল হতে শুরু করলো, যখন যুক্তরাষ্ট্র এসব হামলা সম্পর্কে পাকিস্তানকে আগেভাগে জানানো বন্ধ করে দিলো।
মি. রিডেল বলেন, ‘ড্রোন অপারেশনের শুরুর দিকে আমরা পাকিস্তানকে আগেভাগে আভাস দিতাম যে আমরা কোথায় আঘাত হানছি। এবং তার ফলে প্রত্যেকবারই যা ঘটতো যে আক্রমণের সময় আমাদের লক্ষ্যবস্তুকে আর সেখানে পাওয়া যেতো না। ব্যাপারটা কি তা বোঝার জন্য আপনাকে শার্লক হোমস হতে হবে না।‘
পাকিস্তান অবশ্য সব সময়ই তালেবানদেরকে সরকার বা গোয়েন্দাসংস্থার দিক থেকে সমর্থন দেয়ার কথা অস্বীকার করে আসছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জেনারেল আত্তার আব্বাস বলছেন, প্রকৃত এবং বাস্তব তথ্যগুলোর দিকে তাকালে দেখলে দেখা যাবে যে তা ‘পাকিস্তান রাষ্ট্র বা আইএসআই এসব গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে‘ – এমন ধারণার বিপক্ষে।
তবে আইএসআই-এর সাবেক প্রধান হামিদ গুল বলছেন, পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার জন্য আফগানিস্তানের সাথে সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। তিনি বলেন, ‘আমরা কি আমাদের পেছনে একটা বৈরী আফগানিস্তানকে নিয়ে চলতে পারি? পারি না। তালেবানের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। এটা পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের ব্যাপার এবং এটা সবাই জানে।‘
গত মাসে কাবুলে মার্কিন দুতাবাসে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র যেরকম দ্রুততার সাথে এ ব্যাপারে পাকিস্তানকে দায়ী করলো, তাতে বোঝা যায় যে ওয়াশিংটন তার প্রকাশ্য বিবৃতিতেও এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিতে ইচ্ছুক। কিন্তু নতুন এসব তথ্য থেকে নতুন কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জন্য। কারণ তারা পাকিস্তানকে মিত্র হিসেবে দেখে এবং বড় অংকের আর্থিক সাহায্য দেয়।