তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১লা অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বক্তব্যের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাস্তবতার মুখোমুখি হোন। চরম বিপর্যয়ের আগে জনগণের দাবি মেনে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। নির্যাতন-নিপীড়নের পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক সহনশীলতার পথে আসুন।
গতকাল সোমবার এক প্রেসব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জনগণকে তাদের পছন্দমতো সরকার বেছে নিতে সুযোগ দিন। সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিও জানিয়েছেন তিনি।
গত শনিবার গণভবনে এক প্রেসব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই দেশে নির্বাচন হবে এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী সেই নির্বাচনে আসবেন। রাজনীতি করতে হলে উনাকে নির্বাচনে আসতে হবে।
এর একদিন পর গতকাল আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করল প্রধান বিরোধী দল। দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কর্যালয়ে ব্রিফিংয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধানমন্ত্রী জনগণের মনের কথা বুঝতে ও চোখের ভাষা পড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, শেয়ারবাজারে বিপর্যয়, অর্থনীতির বিপর্যস্ত অবস্থা, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দেশের মানুষের আশা ভঙ্গ করেছে। তিনি অভিযোগ করেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার অতীতের মতো জোর করে দেশকে এক অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীলতা ও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, ১৯৯৫ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আওয়ামী লীগ দিয়েছিল। তাদের সঙ্গে ছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি। মির্জা আলমগীর বলেন, তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা দিনের পর দিন লাগাতার হরতাল, অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশ অচল করে দিয়েছিলেন। তখন দেশের অর্থনীতির কথা, জনগণের দুর্ভোগের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সহিংস আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। মাগুরার নির্বাচনের ধোঁয়া তুলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন যে, দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছিল।গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে যাচ্ছিল। শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতায়, গণতন্ত্রকে অব্যাহত রাখার স্বার্থে, আমরা সেদিন ১৫ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করে, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে সংযোজন করেছিলাম। জনগণ মেনে নিয়েছিলেন। আমরা এই কাজটি করেছিলাম দেশের গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে। পরপর তিনটি নির্বাচন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। নির্বাচনগুলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্যও হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে অভিজ্ঞতার কথা প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন, সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন তারাই। দিনের পর দিন হরতাল, অসহযোগ, সন্ত্রাস, লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষকে প্রকাশ্য রাজপথে হত্যার মধ্যদিয়ে তারাই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করিয়েছিলেন। তারাই বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রকাশ্যে যোগাযোগ করে জাতিসংঘ মিশনের প্রতরণামূলক পত্রের মাধ্যমে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে অবৈধভাবে একটি অসাংবিধানিক সরকার গঠন করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। সেই সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল বলে প্রকাশ্যে ঘোষণাও দিয়েছিলেন। বিদেশে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি (শেখ হাসিনা) বলেছিলেন, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সকল কর্মকা-কে বৈধতা দেবেন, দিয়েছেনও তাই। জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়া যে আলটিমেটাম দিয়েছিলেন সেটাই অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে জরুরি অবস্থা তুলে নিতে বাধ্য করেছিল।
মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের জনগণের কোনো অংশই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে কেটে ফেলতে একমত হননি। এমনকি যে আদালতের দোহাই দেয়া হচ্ছে তারাও আগামী ২টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রাখার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জনমতকে তোয়াক্কা না করে, সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের মতামতকে উপেক্ষা করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে সংসদে মেজরিটির জোরে জাতির ওপর এই ধরনের নির্বাচন চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা আবার দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। পুলিশের বুটের নিচে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পিষ্ট হচ্ছে, নীরব সেন্সরশিপ সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করছে। ব্রুট মেজরিটি গণতান্ত্রিক উদারতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে এখনও অনুরোধ করব, বাস্তবতা উপলব্ধি করুন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পথ পরিহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। জনগণকে তাদের পছন্দমতো সরকার বেছে নিতে দিন।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘টকশোতে সবাই মিথ্যা কথা বলে। আমার জানতে ইচ্ছা করে প্রধানমন্ত্রী কি সত্যকে জানার ইচ্ছাটুকু হারিয়ে ফেলেছেন। সমালোচনা শোনার ন্যূনতম সৎ সাহস তার নেই? আর সে জন্যই কি বাকশালী আদলে বেসরকারি সমপ্রচার নীতিমালা তৈরি করেছেন? সম্পাদকদের জেলে পুরছেন? নিয়ন্ত্রণ করছেন সংবাদ মাধ্যম?
সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা উপস্থিত ছিলেন।