বারিধারা এলাকায় অভিজাত ১ স্কুলছাত্রীর আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ করেন অভিভাবকেরা। খোঁজ নিয়ে তারা যা জানতে পারেন, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। মেয়ে মরণনেশা ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। একইভাবে বনানীতে বেসরকারি ১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ শিক্ষার্থীকে নিয়ে বিব্রত বাবা উচ্চপদস্থ আমলা।

ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করে বাইরে বের হয়, কিন্তু ফেরে অনেক রাতে। আচরণগত পার্থক্য ধরা পড়ে অভিভাবকদের কাছে। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে বেরিয়ে আসে মূল তথ্য। ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছে তাদের সন্তান। ভয়ংকর মাদক ইয়াবার সর্বনাশা থাবায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে এমন অসংখ্য অভিজাত পরিবারের সন্তানদের জীবন। ঢাকার অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকায় নির্বিঘ্নে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা। অভিযোগ রয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সামনে বিক্রি হলেও রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ১ম দিকে ইয়াবা সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চবিত্তদের মধ্যে। এখন সমাজের সব শ্রেণীর মানুষই এই নেশায় আসক্ত। বিস্তার বাড়ার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে প্রশাসনের রহস্যময় নীরবতা। এ ছাড়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে কথিত সমাজসেবীদের অনেকের নামই উঠে এসেছে, যারা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। অনুসন্ধানে জানা যায়, ইয়াবার নেটওয়ার্ক পরিচালিত হয় কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে। আর তা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কয়েক ব্যক্তি। রাজধানীর বনানী, গুলশান ও বারিধারায় রয়েছে তাদেরই মাফিয়া চক্র। এ চক্রের সদস্য রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে বিত্তশালী কয়েকজন ব্যবসায়ী। ইয়াবা ব্যবসায় তারা বানিয়ে ফেলেছেন রাতারাতি কোটি কোটি টাকা। একসময় মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশ করলেও এখন দেশেই তা তৈরি হচ্ছে। থাইল্যান্ড থেকে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও কারিগর এনে গোপনে তৈরি করা হচ্ছে এগুলো। র‌্যাবের অভিযানে গুলশানে এ রকম একটি কারাখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মতে, তবে দেশে তৈরি হলেও থেমে নেই ইয়াবার প্রবেশও। থাইল্যান্ড থেকে বিস্তার শুরু হলেও মিয়ানমার থেকে নাফ নদী পার হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে চলে আসছে ইয়াবার চালান। এর বাইরে কক্সবাজারের উখিয়ার গুন্দুম সীমান্ত দিয়েও ঢুকছে ইয়াবা। কক্সবাজার থেকে রাজধানীতে ইয়াবা ছড়াচ্ছে এখানকার নয়টি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এদের রয়েছে সাব-গ্রুপ। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার একশ্রেণীর মধ্য ও নিম্নবিত্ত বেকার যুবকদের ৮ বা ১০ জনের দল বাসে বা ট্রেনে ঢাকায় আসে। তারাই মূলত এর বাহক। ছোট আকারের এই ট্যাবলেট বহনের কায়দাও অভিনব। শার্টের কলারে, মুঠোফোনের ভেতর, প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে পায়ুপথে ঢুকিয়ে আনার রেকর্ডও রয়েছে। ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে টঙ্গী স্টেশনে নেমে যায় তারা। ওখান থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে জোনভিত্তিক নেতার কাছে ইয়াবা পৌঁছে দেওয়া হয়। আর এগুলো বিক্রি করা হয় শুধু পরিচিত সেবীদের কাছেই। বাংলাদেশে ইয়াবার ১ম প্রবেশ নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০০২ সালে রাজধানীর নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় নেশাজাতীয় এই বড়ি তারা প্রথম উদ্ধার করে। ভারতে ভুলভুলাইয়া, থাইল্যান্ডে চকেলি, ইয়া বাহ বা পাগলা বড়ি আর বাংলাদেশে নেশার রাজ্যে ইয়াবা এখন বহুল পরিচিত নাম। এটি লাল, কমলা বা সবুজ রঙের গোল ছোট একটি ট্যাবলেট। সাধারণ খাওয়ার বড়ির মতো গিলে, চকলেটের মতো চুষে কিংবা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের বড়ি রেখে আগুন বা তাপের দিয়ে নাকে ধোঁয়া টেনে এ বড়ি সেবন করা হয়। বাংলাদেশে ইয়াবা আলোচনায় আসে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। র‌্যাব তাদের অভিযানে রাজধানীর গুলশানে ইয়াবার কারখানা আবিষ্কার করে। তারা সেখান থেকে অর্ধলক্ষাধিক বড়ি উদ্ধার করে। গ্রেফতার করে রহস্যময় ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ভাগ্নে আমিন হুদাকে। এর আগে-পরে গোপনে ইয়াবার ব্যাপক বিস্তার ঘটে সমাজে। ভয়ানক এই নেশার রাজ্যে শুধু যুবতীরাও জড়িয়ে পড়ে। ইয়াবাসম্রাট আমিন হুদার তথ্য অনুযায়ী র‌্যাব অভিযান চালাতে গিয়ে এ ব্যবসায় মডেলদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। পরে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে নিকিতা নামক এক সুন্দরীকে আটক করে শান্তিনগরের কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি থেকে। বেইলি রোডের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে মডেল শাহীনা শীলাসহ ছয় তরুণীকে আটক করা হয়। ইয়াবার বিত্তভিত্তিক নেটওয়ার্ক শুরু হয় নগরীর গুলশান-বারিধারা থেকে। পরে বনানী, নিকতেন ও উত্তরায় তা ছড়িয়ে পড়ে। এসব নেটওয়ার্কে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জড়িয়ে পড়ে। অভিজাত এলাকাগুলোর ক্লাব, রেস্তোরাঁ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজ টার্গেট করে বিস্তারকারীরা। ওই সময় র‌্যাব নেটওয়ার্কের অনেককেই গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে রয়েছে গুলশান-বারিধারার জিতু, জাকির, তমাল ও মিশু। ছাড়া পাওয়ার পর তারা আবারও ইয়াবা ব্যবসায় সসম্পৃক্ত হয়। এই গ্রুপটি অনেক আগে থেকে ইয়াবার ব্যবসা চালিয়ে আসছে বলে জানা গেছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বখে যাওয়া ধনীর সন্তানেরা গড়ে তুলেছে ‘ইয়াবা ক্লাব’। সেখানে দিনে বা রাতে তরুণ-তরুণীরা মত্ত হয় ইয়াবার নেশায়। নানা অপকর্মের নিজেদের সম্পৃক্ত করে। পড়াশোনার নাম করে ক্লাবে জমে ওঠে ইয়াবা আড্ডা। ইয়াবার আড্ডার অভিযোগ রয়েছে রাজধানীর ফু-ওয়াং ক্লাবের বিরুদ্ধেও। গোয়েন্দা সংস্থার সন্দেহের তালিকায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। জানা গেছে, এ ক্লাবে সদস্যও নয় এমন নিম্নশ্রেণীর যুবতীরা সন্ধ্যার পর ভিড় করতে থাকে। ইয়াবার ব্যবসা চলে নগরীর শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণীর শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসেই অবাধে সেবন করে ইয়াবা। অভিজাত এলাকার বাইরে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, মগবাজার-মালিবাগসহ ভিন্ন ভিন্ন জোনে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা বিস্তার করেছে এর জাল। সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা চাকরির পর রাতে ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করে থাকে। এসব তথ্য জানার পরও দুই বছর ধরে ইয়াবার নেটওয়ার্ক ধ্বংসে অভিযান পরিচালনায় শিথিলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে আইনশৃক্সখলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও। ইয়াবা তৈরির অবৈধ কারখানা নগরীতে আরও রয়েছে বলে জানিয়েছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তবে এসব কারখানায় উৎপাদিত হচ্ছে নকল ইয়াবা, অতিমাত্রায় ক্ষতিকর। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেসুর রহমান বলেন, ইয়াবা সম্পর্কিত তথ্য দেওয়া হলে অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে। তবে ইয়াবা নিয়ে র‌্যাবের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ার বিষয়টির সঙ্গে তিনি একমত নন। ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক বলেন, ইয়াবা মস্তিষ্ককে চরমভাবে উদ্দীপ্ত করে। এটি সেবন করলে তাৎক্ষণিকভাবে হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ ও শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং মস্তিষ্কের কিছু কোষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে। ইয়াবা সেবন করা মাত্র হৃদ-দুর্বল ব্যক্তিদের হৃদ্যন্ত্রের ক্রীয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সহিংস যৌনতাও ইয়াবা সেবনের একটি সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যদিও নিয়মিত এক বছর এই বড়ি সেবন করলে যৌনক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এটি সেবনে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ বৃদ্ধি, হজমশক্তি নষ্ট করা এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়া, পিঠে ব্যথা, ফুসফুস ও কিডনি নষ্ট হওয়া ও টাক পড়ার আশঙ্কা থাকে। মনে হতাশা, বিষাদ, ভয়, অনিশ্চয়তার উদ্ভব হতে পারে। এ ছাড়া এটি আচরণগতভাবে সহিংস করে তুলতে পারে।